মঙ্গলবার, ২৯ জুন, ২০১০

বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর কোনটি? বুর্জোয়া গণতন্ত্র নাকি সমাজতন্ত্র?

বাঙলাদশে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বিপ্লবের স্তর কোনটি? বুর্জোয়া গণতন্ত্র নাকি সমাজতন্ত্র? অপর কথায় বাঙলাদশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের গুণগত পরিবর্তনের স্তর কোনটি? বুর্জোয়া গণতন্ত্র নাকি সমাজতন্ত্র? বাঙলাদশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এটা হলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত সমস্যা।

আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বাঙলাদেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বিপ্লবের স্তর কোনটি? বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নাকি সমাজতান্ত্রিক? অর্থাৎ শমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক বা জাতীয় গণতান্ত্রিক? নাকি শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক? বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এটা হলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্বগত সমস্যা।

কমিউনিস্ট তত্বগত বিচারে একটি সামন্তবাদী রাষ্ট্রে সমাজের বিপ্লবের স্তর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। অপরদিকে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সমাজের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। সমাজ বিকাশের ধারায় সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার মূলগত বিপরীত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থা।

একটি সামন্তবাদী সমাজে বুর্জোয়াশ্রেণী দেশের শ্রমিক কৃষকের সাহায্য নিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধানতঃ সম্পন্ন করতে পারে। কিন্তু শ্রেণীচরিত্রের কারণে একটি দেশের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াশ্রেণী (বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি) কখনও সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারেনা। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য।

কেবল শ্রমিকশ্রেণী (কমিউনিস্ট পার্টি) একটি সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যাপক কৃষককে নিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পারে। কেবল শ্রমিকশেণী (কমিউনিস্ট পাার্টি) গরীব কৃষককে নিয়ে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারে (ইতিমধ্যে বুর্জোয়াশ্রেণী কতৃক প্রধানতঃ পরিসমাপ্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করার মধ্য দিয়ে) প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে চীনে এবং দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছে রাশিয়ায়।

এই অর্থে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হলো, শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে (কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে) একটি সামন্তবাদী রাষ্ট্রে সামন্ত স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ করে শ্রমিক কৃষকের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে দেশে কৃষি বিপ্লব সম্পন্ন করা, ভূমি জাতীয়করণ করা ও প্রকৃত কৃষকের মধ্যে জমি লীজ দেওয়া। দেশে বৃহৎ শিল্প কারখানা, ব্যাংক ও বীমা জাতীয়করণ করা।

জনগণনতান্ত্রিক বিপ্লব হলো, একটি সামন্ততান্ত্রিক দেশে ধর্মনিরপেক্ষ ও অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক গণ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান ও সংসদ উচ্ছেদ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান ও সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিবর্তন পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা এবং দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক) বাস্তবায়িত করার জন্য মূলগত ভিত্তি গড়ে তোলা।

এইভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলো একটি পুঁজিবাদী দেশে বুর্জোয়া স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদ করে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। দেশে ইতিমধ্যে প্রধানতঃ পরিসমাপ্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে পরিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করা। দেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ বিষয়ক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচী বাস্তবায়িত করা তথা কামউনিস্ট সমাজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলো বুর্জোয়া রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান ও সরকার উচ্ছেদ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান, সরকার ও সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। শোষণমূলক ও মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ এবং সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী রাষ্ট্রীয় মালিকানা, যৌথ মালিকানা সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র কমিউনিস্ট গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ব্যক্তিমালিকানা ভিত্তিক বুর্জোয়া স্বতন্ত্র জীবনযাপনের গুণগত বিপরীত যৌথ মালিকানা ভিত্তিক ও সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক যৌথ জীবন যাপন ও সুষম কমিউন জীবন যাপন গড়ে তোলা।

বাংলাদেশের সামজে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণের প্রশ্নে বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা প্রধানতঃ দুইভাগে বিভক্ত। বিভিন্ন কারণে কমিউনিস্টদের দুটি অংশের মধ্যে প্রথম অংশটি শারীরিকভাবে বড় এবং দ্বিতীয় অংশটি তত্ত্বের দিক থেকে যুক্তিসংগত ও অগ্রসর ও শক্তিশালী।

কমিউনিস্টদের প্রথম অংশটির মতে বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। বাঙলাদেশের সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এখনও প্রধানতঃ পরিসমাপ্ত নয়। বাংলাদেশের সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রধানতঃ পরিসমাপ্ত হওয়ার পরই বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর হবে সমাজতান্ত্রিক।

কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় অংশটির মতে বাংলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। কারণ বাংলাদেশের সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধানতঃ সম্পন্ন হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধানতঃ সম্পন্ন হয়েছে, সেহেতু বাংলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। পাকিস্তান আমলেও পূর্ববাঙলার সমাজের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রধানতঃ সম্পন্ন ছিল।

বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের প্রথম অংশটির মতে বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। কারণ বাঙলাদেশে পুঁজিবাদ অবিকশিত এবং বাঙলাদেশের পুজিঁ সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজির নিয়ন্ত্রিত, পরাধীন ও অঙ্গীভূত। বাঙলাদেশের পুঁজিবাদ দালাল পুঁজিবাদ। বাংলাদেশের খনিজসম্পদ (তেল, গ্যাস ও কয়লা) সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানী কতৃক নিয়ন্ত্রিত। বাঙলাদেশে কৃষিতে সামন্ত অবশেষে ক্রিয়াশীল।

বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের প্রথম অংশটির মতে বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কারণ। বাঙলাদেশের সমাজে বুর্জোয়া গণতন্ত্র মূলতঃ বিকশিত নয়। বাঙলাদেশের শাসকশ্রেণী বুর্জোয়াশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের দালাল। বাঙলাদেশে অনেকটা সময় সামরিক শাসন জারী ছিল। বাংলাদেশে এখনও আধা-সামরিক শাসন জারী রয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলতঃ নিষিদ্ধ। বাঙলাদেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্র মূলতঃ অনুপস্থিত। বাঙলাদেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রিক পরিবর্তন প্রধানতঃ পরিসমাপ্ত নয়।

বাঙলাদেশের কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় অংশটির মতে বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। কারণ বাঙলাদেশের পুঁজিবাদ বিকশিত। পাকিস্তান আমলেও পূর্ববাঙলার পুঁজিবাদ বিকশিত ছিল। বাংলাদেশে সরকারী শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ার পর ব্যক্তি মালিকানায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। বাঙলাদেশে উৎপাদন সম্পর্ক পুঁজিবাদী। পাকিস্তান আমলেও পূর্ববাঙলার উৎপাদন সম্পর্ক ছিল পুঁজিবাদী। বাংলাদেশের পুঁজিবাদ মূলতঃ স্বাধীন। বাংলাদেশের পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ পরস্পর সম্পর্কিত ও সহযোগী। বর্তমানকালের সাম্রাজ্যবাদ পরোক্ষ। নিজস্ব সরকার (সেনাবাহিনী, ব্যাংক ও বিচারবিভাগ) ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ পরদেশের পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা।

বাঙলাদেশের কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় অংশটির মতে বাঙলাদেশের সমাজের বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। কারণ বাঙলাদেশ রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র। বাঙলাদেশের শাসকশ্রেণী বুর্জোয়াশ্রেণী এবং সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াশ্রেণী পরস্পরের সহযোগী ও বন্ধু। বাঙলাদেশের সমাজে বুর্জোয়া গণতন্ত্র মুলতঃ বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্র। একটি দেশে প্রয়োজনে বুর্জোয়া গণতন্ত্র উদারনৈতিক চরিত্র ধারণ করে এবং প্রয়োজনে বুর্জোয়া গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র চরিত্র ধারন করে।

বাঙলাদেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বিকশিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো চিহ্নিত করা যায়। যেমন, বাঙলাদেশের জমিদার প্রথার উচ্ছেদ, ভূমি, শিল্প, ব্যাংক ও বীমায় ব্যাক্তি মালিকানার অধিকার প্রতিষ্ঠিত, দেশে সংবিধান, সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট, নিম্ন আদালতের উপস্থিতি, সারাদেশে উচ্চ শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষতঃ নারী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার, সার্বজনীন ভোটাধিকার বিশেষতঃ নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দেশে দৈনিক জাতীয় সংবাদপত্র ও পুস্তক প্রকাশনার অধিকার প্রতিষ্ঠিত। বাঙলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিকশিত।

বাঙলাদেশের কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় অংশটির মতে শ্রমিকশ্রেণীর (কমিউনিস্টদের) কর্তব্য হলো বাঙলাদেশে একইসঙ্গে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম (সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) সংগঠিত করা। বাঙলাদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ছাড়া সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে পারেনা। তবে বাঙলাদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম হলো সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের (সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) সঙ্গী, অংশ ও অধীন। সমাজের গুণগত বিকাশের ধারায় বাঙলাদেশে শ্রমিকশ্রেণীর (কমিউনিস্টদের) সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম প্রধান।

বাঙলাদেশের কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় অংশটির মতে দেশে জরুরী আইন প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ডের অধিকারের দাবীতে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম হলো মূলতঃ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম। আর বাঙলাদেশের আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও সরকারের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হলো সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম। গুণগত বিকাশের ধারায় বাঙলাদেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বুর্জোয়া গণতাান্ত্রিক সংগ্রাম হলো সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের (সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) অধীন।

কমিউনিস্ট তত্ত্বগত বিচারে, একটি দেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বিপ্লবের স্তর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র নির্ধারণের দিকটি। একটি দেশের রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্রের গুণগত বিপরীত হলো সমাজের বিপ্লবের শ্রেণীচরিত্র। তবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বিপ্লবের কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার মাত্রা এবং মেহনতী জনগণের সংগঠনের বিকাশের মাত্রা ও মেহনতী জনগণের চেতনার মাত্রা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

যেহেতু বাস্তব ক্ষেত্রে ও কমিউনিস্ট তত্ত্বগত বিচারে, বাঙলাদেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজরে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক। সেহতেু বাঙলাদেশের অগ্রসর কমিউনিস্টদের কর্তব্য হলো দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম সংগঠিত করা। তবে এক্ষেত্রে বাঙলাদেশের অগ্রসর কমিউনিস্টদের প্রথম প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচী বিশেষতঃ রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করা।

বাঙলাদেশের অগ্রসর কমিউনিস্টদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হলো দেশে শাসক বৃর্জোয়া ও সরকার বিরোধী সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের পাশাপাশি একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রাম সংগঠিত করা। তবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম (বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) এবং ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম (বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) হলো দেশে চলমান সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের (সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) অংশ ও অধীন।

কমিউনিস্ট তত্ত্বগত বিচারে বাঙলাদেশে এসময়ে সমাজতান্ত্রিক মূল রাজনীতি হলো বাঙলাদেশের আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও সরকারের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। বাঙলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সংবিধান ও বুর্জোয়া সংসদের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক সংবিধান ও সমাজতান্ত্রিক সংসদ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি।
বাঙলাদেশে এসময়ে আশু সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি হলো বুর্জোয়া জাতীয় সংসদের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক সংবিধান পরিষদ ও সমাজতান্ত্রিক সংসদ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। এইভাবে, বুর্জোয়া সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলাপরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক সিটি কর্পোরেশন, সমাজতান্ত্রিক পৌরসভা, সমাজতান্ত্রিক উপজেলা পরিষদ ও সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার রাজনীতি।
সঙ্গত কারণে বাঙলাদেশে আগামীদিনের সমাজতান্ত্রিক সংবিধান, সমাজতান্ত্রিক সংসদ, সমাজতান্ত্রিক সিটি কর্পোরেশন, সমাজতান্ত্রিক পৌরসভা, সমাজতান্ত্রিক জেলা পরিষদ, সমাজতান্ত্রিক উপজেলা ও সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ও সমাজতান্ত্রিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামো বিশিষ্ট।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো রাষ্ট্রীয় মালিকানা, যৌথ মালিকানা ও সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গতিপূর্ণ ফলশ্রুতি শিল্প কমিউন ও কৃষি কমিউন এবং শোষণমুক্ত জনগনের স্বশাসন। সমাজতান্ত্রিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামো যৌথ মালিকানা ভিত্তিক। সমাজতান্ত্রিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামোর সঙ্গতিপূর্ণ ফলশ্রুতি শোষনমুক্ত জনগনের যৌথ জীবন যাপন।

এই কারণে বাঙলাদেশে এসময়ে তাৎপর্যপূর্ণ আশু সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি হলো বিদ্যমান বেসামরিক সামরিক বুর্জোয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুণগত বিপরীত সমাজতান্ত্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। শ্রমিক গরীব কৃষক মেহনতী মানুষের প্রাধান্যভিত্তিক বিপ্লবী গণঅভু্যত্থানের মাধ্যমে এবং শ্রমিক গরীব কৃষক মেহনতী মানুষের বিপ্লবী আন্দোলকারী সংস্থাগুলো দ্বারা গঠিত সমাজতান্ত্রিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি।

প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের সমাজে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রধানতঃ সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, সাতচলি্লশের ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং বাঙলাদেশের একাত্তরের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি বাঙলাদেশের (১৯৪৭-২০০৮) সমাজে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রধানতঃ পরিসমাপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সমাজের গুণগত পরিবর্তনের ধারায় বাঙলাদেশের শ্রমিকশ্রেণী ও গরীব কৃষক মেহনতী মানুষের মুক্তিসংগ্রামের শ্লোগান সমাজতন্ত্র। বাঙলাদেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বিকাশমান বুর্জোয়া গণতন্ত্র হলো বিকাশমান সমাজতন্ত্রের সঙ্গী, অংশ ও অধীন।
২৯.০৬.২০০৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন