মার্কসবাদ হলো শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী ভাবাদর্শ বা মতবাদ। মার্কসবাদ কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ বা মতবাদ। তত্ত্বগত মানেরদিক থেকে, কমিউনিস্ট আন্দোলনে কেবল মার্কসবাদই গুণগত। পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়া মতবাদের গুণগত বিপরীতসৃজনশীলভাবে বিকশিত শ্রমিকশ্রেণীর মতবাদ মার্কসবাদ। চিরায়ত বুর্জোয়া দর্শনের (জার্মান দর্শন), অর্থনীতি (বৃটিশঅর্থনীতি) ও রাজনীতির (ফরাসী সমাজতন্ত্র ) বিচারমূলক সমালোচনা ভিত্তিক গুণগত বিপরীত মার্কসবাদের দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি।
বুর্জোয়া মতবাদের দার্শনিক ভিত্তি ভাববাদ। শ্রমিকশ্রেণীর মতবাদ বা মার্কসবাদের দার্শনিক ভিত্তি বস্তুবাদ দ্বন্দ্বমূলকবস্তুবাদ। বুর্জোয়া মতবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ব্যক্তিগত মালিকানা। মার্কসবাদের বা কমিউনিস্ট মতবাদের অর্থনৈতিকভিত্তি সামাজিক মালিকানা।
মার্কর্সবাদের সার কথা প্রথমতঃ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। যা হলো মূলতঃ মানব ইতিহাস ও মানব সমাজেরবিকাশের অন্তর্নিহিত নিয়মসমূহের বিজ্ঞান। দ্বিতীয়তঃ উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব। যা হলো মূলতঃ পুঁজিবাদী সমাজের আভ্যন্তরীণবিরোধ, গুণগত রূপান্তর ও অনিবার্য পরিনতির অন্তর্নিহিত নিয়সমূহের বিজ্ঞান । তৃতীয়তঃ প্রলেতারীয় একনায়কত্ব। যাহলো মূলতঃ পুঁজিবাদ উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে প্রলেতারিয়েতের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
প্রকৃতি, সমাজ ও মানব চিন্তা ভিত্তিক ভাবাদর্শে, মার্কসবাদের বিকাশ সর্বোচ্চ। দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবাদর্শে, মার্কসবাদের বিকাশ সবার শীর্ষে। বুর্জোয়া দার্শনিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতির গুণগত বিপরীতমার্কবাদী দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি পরিপূর্ণ, সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ কারণেমার্কসবাদ একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদ প্রধানতঃ ভাবাদর্শগত ব্যবস্থা।
মার্কসবাদের মূল তত্ত্ব্গুলির ভিত্তিতে সমগ্র মার্কসবাদে, লেনিনের অবদান অতুলনীয়। আসলে লেনিনবাদ মার্কসবাদ ভিত্তিকতাৎপর্যপূর্ণ সৃজনশীল কমিউনিস্ট মতবাদ। অপর কথায় লেনিন মার্কসবাদের ভিত্তিতে সুবিন্যস ও চমৎকারভাবেমার্কসবাদী দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতির মূল দিকগুলির বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। মার্কসবাদের ভিত্তিতেলেনিন পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে কমিউনিস্ট দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সৃজনশীল বিকাশ সাধনকরেন।
ঐতিহাসিক কারণে মার্কসবাদের সঙ্গে লেনিনবাদ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। লেনিনবাদের মাধ্যমে সর্বাঙ্গীনমার্কসবাদ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্ট কর্মীর নিকট সুপরিচিত। গভীর অর্থে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অখন্ড কমিউনিস্টমতবাদ। বর্তমান কালের মার্কসবাদ বস্তুতঃ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিশ্বজনীন কমিউনিস্ট মতবাদকমিউনিস্ট ভাবাদর্শ।
সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সামগ্রিক রূপ। সমাজতন্ত্র -কমিউনিজম প্রধানতঃ সমাজব্যবস্থা।সমাজব্যবস্থায়, সমাজতন্ত্র -কমিউনিজমের বিকাশ সর্বোচ্চ। সমাজতন্ত্র -কমিউনিজম সবচেয়ে অগ্রসর সবচেয়ে পরিপূর্ণসমাজব্যবস্থা। সমাজতন্ত্র কমিউনিজমের নিম্ন পর্যায় বা প্রথম পর্যায়। কমিউনিজম সমাজতন্ত্রের উচ্চতর পর্যায় বা দ্বিতীয়পর্যায়। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভিত্তি ব্যক্তিগত মালিকানা। কমিউনিস্টসমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভিত্তি সামাজিক মালিকানা।
সাধারণ অর্থে, সমাজতন্ত্র হলো শ্রেণীর বিলোপ। সুনির্দিষ্ট অর্থে সমাজতন্ত্র হলো শ্রেণীর বিলোপের প্রথম পর্যায়। এইবিলোপের জনা প্রলেতারীয় একনায়কত্ব বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এই পর্যায়ের মূল কর্মসূচী হলোঃ সামগ্রিকভাবে ভূমিজাতীয়করণ। বিশেষভাবে বৃহৎ কৃষি খামার, শিল্প ও আবাসনে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ। ব্যাপক মেহনতী নর নারীবিশেষতঃ গরীব কৃষকের যৌথ উৎপাদন (সমবায় ব্যবস্থা) প্রবর্তন। শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে পার্থক্য বিলোপ। সমাজতন্ত্রেরএকটি মূলনীতি প্রত্যেকে কাজ করবে তার সাধ্যমত, প্রত্যেকে পাবে তার কাজ অনুযায়ী।
সঙ্গত কারণে মার্কস ও এঙ্গেলস সমাজতন বিনির্মাণের সমস্যাগুলি সুসপষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। একইসঙ্গে তাঁরা এইসমস্যাগুলির যথাযথ সমাধানের মূল দিকগুলিও তুলে ধরেন। মার্কস ও এঙ্গেলস দেখান কেমন করে কমিউনিজমের ভেতরদিয়ে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণের তাৎপর্যপ র্ণ সমস্যাগুলিরও যথাযথ সমাধান হবে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মূল তত্ত্বের ভিত্তিতেলেনিন সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণ বিষয়ক সমস্যা এবং এগুলির সমাধান সুসপষ্টভাবে, সুনির্দিষ্টভাবে ও সৃজনশীলভাবে বিশদব্যাখ্যা করেন।
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বা প্রলেতারীয় একনায়কত্বের যুগে শ্রেণী থাকে এবং শ্রেণীসংগ্রাম থাকে তীব্রভাবেই। পুঁজিপতিদেরউচ্ছেদ করা হয়, কিন্তু পুঁজিবাদ থাকে। কৃষক অর্থনীতি রূপে সমাজে ক্ষুদে পণ্য থেকে যায়। এটা পুঁজিবাদের ব্যাপক ও দৃঢ়প্রোথিত ভিত্তি। এই ভিত্তিতে পুঁজিবাদ থাকে ও পুনরুতপাদিত হয় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নির্মম সংগ্রামে।
প্রলেতারীয় একনায়তন বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া শ্রেণী বিলোপ হবেনা। শ্রেণী বিলোপের পর প্রলেতারীয় একনায়কত্বেরপ্রয়োজন থাকবে না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পরিপক্ক না হওয়া পর্যন , পুঁজিবাদী চিহ্ন বিলোপ না হওয়া পর্যন্ত ও বুর্জোয়াঅধিকার বিলোপ না হওয়া পর্যন্ত বুর্জোয়া রাষ্ট্র টিকে থাকে- বুর্জোয়া ছাড়া !
কমিউনিজম হলো রাষ্ট্রের বিলোপ। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্র ও শ্রেণীর বিলোপের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কমিউনিজমে রাষ্ট্র ও শ্রেণীরবিলোপ ঘটবে পরিপূর্ণভাবে। কমিউনিজমে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও যৌথ মালিকানার রূপান্তর ঘটবে সামাজিক মালিকানায়।সমাজে বুর্জোয়া অধিকারের বিলোপ ঘটবে এবং কায়িক ও মানসিক শ্রমের পার্থক্যের অবসান ঘটবে। কমিউনিজমের একটিমূলনীতি হলো প্রত্যেকে কাজ করবে তার সাধ্যমত, প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী মতবাদ কমিউনিস্ট মতবাদ (দার্শনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক) গড়ে তোলারঐতিহাসিক দায়িত্ব বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী, তাত্তি্বক ও নেতা মার্কস ও এঙ্গেলসের উপর অর্পিত হয়। বিশেষতঃ সমাজতন্ত্রকমিউনিজম বিনির্মাণের তত্ত্ব বিকশিত করার জন্য মার্কস ও এঙ্গেলসের সামনে ইতিহাস নির্দিষ্ট দায়িত্ব উপস্থিত হয়।পরিশ্রম ও মেধার সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলস এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন এবং এরা দুজন বিশ্বেরশ্রমিকশ্রেণীর শিক্ষকে পরিণত হন। -
ফলে কমিউনিস্ট মতবাদ গড়ে তোলা বিশেষতঃ সমাজতন -কমিউনিজম বিনির্মানের মূল তত্ত্ব বিকশিত করার ঐতিহাসিকদায়িত্ব আর কারও নেয়ার প্রয়োজন থাকলো না। এবার এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাজটি হলো মার্কসবাদের মূল তত্ত্বের ভিত্তিতেসকল প্রকার সংশোধনবাদ, নৈরাজ্যবাদ ও সংকীর্ণবাদের আক্রমণ থেকে মার্কসবাদকে রক্ষা করা। মার্কসবাদের মূল তত্ত্বেরভিত্তিতে সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদকে বিকশিত করা। আর এই অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ কাজটি পরিশ্রম ও মেধার সঙ্গেযথাযথভাবে সমপন্ন করেন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী, তাত্ত্বিক ও নেতা লেনিন বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে।
মার্কস ও এঙ্গেলস উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্বে সাম্রাজ্যবাদের মূল তত্ত্ব (অবাধ প্রতিযোগিতা একচেটিয়ায় পরিণতহওয়ার তত্ত্ব) প্রতিষ্ঠিত করেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের এই মূল তত্ত্বের ভিত্তিতে লেনিন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সৃজনশীলভাবেসাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বের বিকাশ সাধন করেন। মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের রচনাগুলির মধ্যে একথার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়াযায়।
বিশেষতঃ সমাজতন বিনির্মাণের মূল তত্ত্বকে কেন্দ্র করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে নানা রকম বিভ্রান্তি রয়েছে। এই প্রশ্নেআসল কথা হলো সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের ক্ষেত্রে মার্কস ও এঙ্গেলসের মূল তত্ত্বগুলিই পরিপূর্ণ সুসপষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও যথাযথ।মার্কস ও এঙ্গেলসের মূল তত্ত্বের ভিত্তিতে কেবল লেনিন সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের তত্ত্ব সুসপষ্ট, সুনির্দিষ্ট, যথাযথ ওসৃজনশীলভাবে বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন।
বাঙলাদেশের অগ্রসর কমিউনিস্টদের ইতিহাস নির্দিষ্ট দায়িত্ব হলো সংশোধনবাদী, নৈরাজ্যবাদী ও সংকীর্ণতাবাদী ধারারআক্রমণ থেকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা করা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল তত্ত্বের ভিত্তিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকেসৃজনশীলভাবে বিকশিত করা। আসলে কমিউনিস্ট আন্দোলনে আজ পর্যন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যুগই ক্রিয়াশীল।এমনকি সমগ্র পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র -কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যুগই ক্রিয়াশীল থাকবে।
তারিখঃ ১৯.০৮.২০১০
