বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটি তত্ত্বগত প্রশ্ন সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত ও আলোচিত। এই তত্ত্বগত প্রশ্নটি হলো বাঙলাদেশের শ্রমিকশ্রেণীর মেহনতী জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পথে প্রধান সমস্যা প্রধান বাধা কোনটি? সুনির্দিষ্ট অর্থে এই তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্বগত প্রশ্নটি হলো বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের চলমান মুক্তিসংগ্রামে প্রধান বিপদ প্রধান শত্রু কোনটি?
বিশদ করে বলা যায় বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের প্রধান বিপদ প্রধান শত্রু কি বাঙলাদেশের পুঁজিবাদ ও বাংলাদেশের বুর্জোয়া সরকার? সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া সরকার? ভারতের আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদ ও ভারতের আধিপত্যবাদী বুর্জোয়া সরকার? অথবা বাঙলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদ ও বাঙলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদী বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠনগুলি?
দুঃখজনক হলেও একথা সত্য স্বাধীনতার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু নির্ণয় বিষয়ক তত্ত্বগত প্রশ্নটির এখনও যথাযথ সমাধান হয়নি। বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবশালী অংশগুলি এখনও মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রুটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে মূলতঃ সক্ষম নয়। একথা পরাধীন ভারত এবং স্বাধীনতা উত্তর ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবশালী অংশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কঠিন সত্য হলো দীর্ঘদিন যাবত বাঙলাদেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনগণের মুক্তিসংগ্রাম জাতীয় পর্যায়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নয়। বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন গুণগতভাবে বিকশিত নয়। বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু বিষয়ক তত্ত্বগত বিভ্রান্তিই এক্ষেত্রে প্রধানতঃ দায়ী। অথচ প্রধান শত্রু সঠিকভাবে নির্ধারণ করা ছাড়া বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের মুক্তিসংগ্রাম গুণগত বিকাশ লাভ করতে পারেনা।
বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন শিক্ষা দেয় একটি দেশে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাসীন সরকার দেশের শ্রমিকশ্রেণীর মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু। ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী সংগ্রাম মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম। মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু ও প্রধান সংগ্রাম নির্ণয় বিষয়ক এই তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্বগত লাইনের সুস্পষ্ট প্রমাণ নিশ্চিত হয় ফ্রান্সের প্যারী কমিউন ও রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের ইতিহাসের ভেতর।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতে ক্ষমতাসীন সরকার বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার ফল। একই সঙ্গে সরকার বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালক ও স্বার্থরক্ষক। ক্ষমতাসীন সরকার শাসকশ্রেণীর মূর্তরূপ। ক্ষমতাসীন সরকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শাসকশ্রেণীর পরাক্রমশালী অংশ। ক্ষমতাসীন সরকার শাসকশ্রেণীর পরিচালক।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাসীন সরকার প্রধান উৎপীড়ন যন্ত্র ও প্রধান নির্বাহী কর্তৃত্ব। সরকার শ্রেণীনিপীড়নের হাতিয়ার। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাসীন সরকার মেহনতী জনগণের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিসাধন করে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রধান আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতাসীন সরকারই দেশের মেহনতী জনগণের অন্যান্য শত্রুদের নিরাপত্তা প্রদান করে ও তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করে। ক্ষমতাসীন সরকার সেনাবাহিনী, পুলিশ, ব্যাংক, বিচার বিভাগ ও পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে। সামরিক শাসনও সামরিক সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়। আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক বুর্জোয়া প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যকার পার্থক্য ক্রমশঃ হ্রাস পায়। শেষ বিশ্লেষণে সরকারই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রই সরকার।
ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী সংগ্রাম প্রধানতঃ রাজনৈতিক সংগ্রাম। সরকার বিরোধী সংগ্রাম মূলতঃ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রাম। কলকারখানার মালিক বিরোধী সংগ্রাম প্রধানতঃ অর্থনৈতিক সংগ্রাম। সরকার বিরোধী সংগ্রাম পুরাতন রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্ছেদ ও নতুন রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী সংগ্রাম একই সঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা (রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা) এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (উৎপাদন ব্যবস্থা) উচ্ছেদের সংগ্রাম।
এপ্রসঙ্গে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে আলোচিত আরও একটি তত্ত্বগত প্রশ্ন উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাহলো বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম কোনটি? অভ্যন্তরীণ শ্রেণীসংগ্রাম নাকি জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম? বাঙলাদেশের পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম? সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম? ভারতীয় আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম? বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগ্রাম?
বর্তমান যুগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগ। উন্নয়নশীল দেশগুলির দেশীয় পুঁজিবাদের প্রবল বিকাশের যুগ এবং দেশীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও সরকারগুলির অধিকতর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার যুগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেশিরভাগ দেশে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণের অবসান ঘটে। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এসকল দেশে পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশ ঘটে ও পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে ওঠে। এসকল উন্নয়নশীল দেশ বস্তুতঃ স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশে ও রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এইভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ শোষণের মাত্রা ক্রমশঃ হ্রাস পায়।
তত্ত্বগত বিচারে, পরাধীন দেশে (পুঁজিবাদী অথবা সামন্তবাদী) সাম্রাজ্যবাদের শোষণ মূলতঃ রাজনৈতিক। যেমন বৃটিশ ভারত ও ফ্রেঞ্চ সিরিয়ার ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। স্বাধীন দেশে (পুঁজিবাদী অথবা সামন্তবাদী) সাম্রাজ্যবাদের শোষণ মূলতঃ অর্থনৈতিক। যেমন স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন সিরিয়ার ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। পরাধীন দেশে (পুঁজিবাদী অথবা সামন্তবাদী) মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম মূলতঃ গণতান্ত্রিক। স্বাধীন দেশে (পুঁজিবাদী) মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম মূলতঃ সমাজতান্ত্রিক।
প্রকৃতপক্ষে বাঙলাদেশে শ্রমিকশ্রেণীর মেহনতী জনগণের উপর ক্ষমতাসীন দেশীয় বুর্জোয়া সরকারের দেশীয় পুঁজিবাদের শোষণ নির্যাতন প্রধান। একই সঙ্গে পাশাপাশি বাঙলাদেশে মেহনতী জনগণের উপর সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ শোষণও বিদ্যমান। তবে বাঙলাদেশে শ্রমিকশ্রেণীর মেহনতী জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পথে প্রধান বিপদ প্রধান শত্রু হলো ক্ষমতাসীন দেশীয় বুর্জোয়া সরকার দেশীয় পুঁজিবাদ। এসব কথা সকল উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তত্ত্বগত বিচারে বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম হলো ক্ষমতাসীন দেশীয় বুর্জোয়া সরকার (দেশীয় পুঁজিবাদ) বিরোধী সংগ্রাম। একই সঙ্গে পাশাপাশি বাঙলাদেশের মেহনতী জনগণের অন্যতম মূল শত্রু সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া সরকার (সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ) বিরোধী সংগ্রাম, ভারতের আধিপত্যবাদী বুর্জোয়া সরকার (ভারতীয় আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদ) বিরোধী সংগ্রাম ও বাঙলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদ (বাঙলাদেশ ধর্মীয় মৌলবাদী বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠনগুলি) বিরোধী সংগ্রাম। তবে সঙ্গত কারণে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রাম হলো দেশীয় বুর্জোয়া সরকার বিরোধী সংগ্রামের অধীন। এসব কথা উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
তথাপি দীর্ঘদিন যাবত বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবশালী অংশ প্রধানতঃ সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ শোষণ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ফলে বাঙলাদেশে মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু (ক্ষমতাসীন দেশীয় বুর্জোয়া সরকার) বিরোধী সংগ্রাম যথাযথ গুনগতভাবে বিকাশলাভ করেনি। স্বাধীনতা উত্তর উন্নয়নশীল দেশগুলির বিশেষতঃ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাঙলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ার কমিউনিস্ট রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যর্থতার ইতিহাস তার প্রমাণ।
মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু ও প্রধান সংগ্রাম যথাযথ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবশালী অংশের তত্ত্বগত ভ্রান্তির পেছনে প্রধানতঃ দায়ী লেনিন উত্তর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি ভ্রান্ত তত্ত্বগত লাইন। তা হলো রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা বিষয়ক একটি পশ্চাদপদ তত্ত্বগত আইন। এইভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবশালী অংশের তত্ত্বগত বিভ্রান্তির পেছনেও প্রধানতঃ দায়ী লেনিন উত্তর রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা বিষয়ক পশ্চাদপদ তত্ত্বগত এই লাইনটি।
সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা বিষয়ক এই বিভ্রান্তিকর তত্ত্বগত লাইনটি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে পরিচিত। প্রথমতঃ তা হলো রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতে সাম্রাজ্যবাদ (প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ) উন্নয়নশীল দেশগুলির মেহনতী জনগণের মুক্তিসংগ্রামের পথে প্রধান বিপদ প্রধান শত্রু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণের অবসানের পর সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন এখনও আগের মতোই মূলতঃ ক্রিয়াশীল।
দ্বিতীয়তঃ তা হলো সাম্রাজ্যবাদের নানা রকম বাধা ও ষড়যন্ত্রের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুঁজিবাদের বিকাশ মূলতঃ ঘটেনা। সাম্রাজ্যবাদের একটানা শোষণের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আত্মনির্ভরশীল পুঁজিবাদ বা স্বাধীন পুঁজিবাদ গড়ে উঠেনা। এক কথায় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের কারণে এসকল দেশে পুঁজিবাদী সমাজ মূলতঃ সৃষ্টি হয়না।
আসলে মূল বিষয়টি হলো লেনিন উত্তর রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথমতঃ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণ ও পরোক্ষ শোষণের মধ্যকার মৌলিক কোন পার্থক্য চিহ্নিত করেনা। দ্বিতীয়তঃ প্রভাবশালী দুটি কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য স্বীকার করেনা।
কিন্তু বাস্তব ঘটনা এরকম নয়। সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণ ও পরোক্ষ শোষণের মধ্যকার মৌলিক পার্থক্য বস্তুতঃ বিদ্যমান। এই মৌলিক পার্থক্যটি হলো এক্ষেত্রে উপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সরকারের উপস্থিতি অথবা অনুপস্থিতি। যেমন পরাধীন ভারতে বৃটিশ উপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সরকারের উপস্থিতি ছিল। স্বাধীন ভারতে বৃটিশ উপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সরকারের উপস্থিতি নেই। পরাধীন সিরিয়া ও স্বাধীন সিরিয়ার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে পুঁজিবাদের বিকাশ অবজেক্টিভ ব্যাপার। সামন্তবাদী সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন শক্তির বিরোধের কারণে পুঁজিবাদের বিকাশ অনিবার্য। সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুঁজি বিনিয়োগের পরেও পরাধীন দেশে পুঁজিবাদের বিকাশ বেগবান হয়। পরাধীন ভারতে বা বৃটিশ ভারতে পুঁজিবাদের উল্লেখযোগ্য বিকাশ তার প্রমাণ। বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে এসব কথা প্রযোজ্য।
বাঙলাদেশে (পূর্ববাংলা) পুঁজিবাদের বিকাশের ধারা মোঘল আমলে বৃহত্তর ভারতে গড়ে ওঠা পণ্য অর্থনীতির ধারাবাহিকতা। বাঙলাদেশের পুঁজিবাদের বিকাশের ধারা বৃটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণের অবসানের পর স্বাধীন ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানেও পুঁজিবাদী অর্থনীতি ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে উঠে। রাজনৈতিকদের স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানে স্বাধীন পুঁজিবাদ বা আত্মনির্ভরশীল পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানে পুঁজিবাদ সমাজ গড়ে ওঠে।
দীর্ঘদিন আগে বাঙলাদেশে মানুষের শ্রম মানুষের শ্রমশক্তি পণ্যে পরিণত হয়েছে। বাঙলাদেশের জমি পণ্যে পরিণত হয়েছে অনেকদিন আগে। বাঙলাদেশের উৎপাদনের যন্ত্রপাতিরও উৎপাদন হয়। বাঙলাদেশে কোটি কোটি মানুষ জমি ও কৃষি যন্ত্রপাতি থেকে বিচ্ছিন্ন। এসকল ভূমিহীন মানুষ শহরে ছোট, মাঝারি ও বড় কলকারখানায় এবং নানারকম শ্রম পেশায় কর্মরত। লক্ষ লক্ষ নিম্ন আয়ের মানুষ এখন বছরের পর বছর প্রবাসে শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে কর্মরত।
বাঙলাদেশের সঙ্গে পৃথিবীর বড় বড় পুঁজিবাদী দেশ ও উন্নয়নশীল পুঁজিবাদী দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বাঙলাদেশে দুটি পুঁজিবাজার ক্রিয়াশীল। বাঙলাদেশের পুঁজি বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। বাঙলাদেশে উৎপাদিত নানা রকম পণ্য বিদেশে রপ্তানী করা হয় এবং বিভিন্ন দেশের উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে বাঙলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত। বাঙলাদেশে পুঁজিপতিরা ব্যবসায়ীরা দেশে নিজেদের প্রয়োজনে বহু সংখ্যক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেছে।
লেনিন উত্তর রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা বিষয়ক পশ্চাদপদ তত্ত্বগত লাইন দুই পার্টির পররাষ্ট্র নীতি হিসেবেও পরিচিত। রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আরোপিত পররাষ্ট্র নীতির (সংস্কারবাদী ও নৈরাজ্যবাদী) কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া সরকার বিরোধী সংগ্রাম গুণগত বিকাশলাভ করেনি। একই কারণে এসকল দেশে বুর্জোয়া সরকার উচ্ছেদ ও সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যথাযথ সংগঠিত হয়নি। স্বাধীনতা উত্তর পুঁজিবাদী দেশ ও বুর্জোয়া রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও বাঙলাদেশে প্রধানতঃ পুঁজিবাদ উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যথাযথ গড়ে উঠেনি। এসকল দেশে বুর্জোয়া সরকার উচ্ছেদ ও সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যথাযথ সংগঠিত হয়নি।
বিভ্রান্তিকর ও আরোপিত তত্ত্বের ভিত্তিতে রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি উন্নয়নশীল দেশগুলির কিছু কিছু বুর্জোয়া সরকার প্রধানকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে। এই দুই পার্টি নির্দিষ্ট উন্নয়নশীল দেশের কমিউনিস্টদের প্রধানতঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলার পরামর্শ দেয় এবং ক্ষমতাসীন এসকল প্রতিক্রিয়াশীল বা স্বৈরাচারী বুর্জোয়া সরকার প্রধানকে সহযোগিতা করার পরামর্শ দেয়। এসকল বুর্জোয়া সরকার প্রধান হলো নাসের, সুকর্ণ, নেহেরু, হাফেজ আসাদ, সাদ্দাম, ইন্দিরা গান্ধী, মিসেস বন্দর নায়ক, আইউব খান, নক্রুমা, গাদ্দাফি প্রমুখ।
রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি উন্নয়নশীল দেশগুলির কিছু কিছু ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল বা স্বৈরাচারী বুর্জোয়া সরকার ও সরকার প্রধানকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বা চাকর বাকর হিসেবে চিহ্নিত করে। প্রভাবশালী এই দুই পার্টি নির্দিষ্ট উন্নয়নশীল দেশগুলির কমিউনিস্টদের ক্ষমতাসীন এসকল স্বৈরাচারী বুর্জোয়া সরকার ও সরকার প্রধানকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রধানতঃ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তোলার পরামর্শ দেয়। এসকল বুর্জোয়া সরকার প্রধান হলো আনোয়ার সাদাত, মোবারক, আইউব খান, মাহেলা জয়বর্ধন, সুহার্তো প্রমূখ।
রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি উন্নয়নশীল দেশগুলির পুঁজিবাদকে সাধারণতঃ মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ হিসাবে চিহ্নিত করে। এরকম আরোপিত ও ভ্রান্ত তত্ত্বগত লাইনের কারণে এই দুই কমিউনিস্ট পার্টি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে (স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশ ও স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র) বাস্তবে প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামকেও নাকচ করে তার স্থানে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সঠিক সংগ্রাম বলে উপস্থিত করে।
শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা বিষয়ক ভ্রান্ত তত্ত্বগত লাইনের কারণে রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি পঞ্চাশ দশকে ষাট দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বৈরাচারী বুর্জোয়া সরকার প্রধানদের নিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এই দুই পার্টি উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বৈরাচারী বুর্জোয়া সরকার প্রধানদের নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের মেহনতী জনগণের মুক্তিসংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
প্রধানতঃ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্ব অস্বীকার করার কারণে রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিজ নিজ দেশের মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু সাম্রাজ্যবাদকে উন্নয়নশীল দেশগুলির (রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলি) মেহনতী জনগণের প্রধান শত্রু হিসাবে চাপিয়ে দেয়। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলির কমিউনিস্ট আন্দোলনের গুরুতর ক্ষতিসাধন হয়। সঙ্গত কারণে নিজ নিজ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে উন্নয়নশীল দেশগুলির অগ্রসর বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কর্তব্য হলো রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উপরোক্ত বিভ্রান্তিকর তত্ত্বগত লাইনকে প্রত্যাখ্যান করা।
লেনিন উত্তর রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিজ নিজ দেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া জয়যুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রশ্নে অগ্রসর তত্ত্বগত লাইন উপস্থিত করতে পারেনি। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব আজ আর নেই। কিন্তু এই দুই পার্টির সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা বিষয়ক পশ্চাদপদ তত্ত্ব বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন এখনও ক্রিয়াশীল।
আমাদের মতে লেনিন উত্তর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চাদপদ ও বিভ্রান্তিকর তত্ত্বগত লাইনটির অবসান ঘটবে। এটা সম্ভব প্রধানতঃ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বাস্তব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
পরিশেষে বলি, বাঙলাদেশের অগ্রসর ও বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কর্তব্য প্রধানতঃ দেশীয় পুঁজিবাদ উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সংগঠিত করা। ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া সরকার উচ্ছেদ ও সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম গড়ে তোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ শোষণের অবসানের পর উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। ধন্যবাদ।
তারিখ : ২৩.১২.২০১১ আইউব রেজা চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন