বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১১

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও আসাদের মৃত্যুর তাৎপর্য

(১)
বিকাশের নিয়মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্রনেতা (ছাত্র ইউনিয়ন) আসাদের মৃত্যুতে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সূচনা। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রথমতঃ পাকিস্তানের পুঁজিবাদী শোষণ বিরোধী পূর্ববাঙলার শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী পূর্ববাঙলার নিপীড়িত জাতিসমূহের মেহনতী জনগণের সংগ্রাম।

পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টরা আন্তরিকভাবে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু লেনিন উত্তর রাশিয়া ও চীনের ভ্রান্ত তত্ত্বগত লাইনের কারণে সঠিক কমিউনিস্ট কর্মসূচীর রাজনৈতিক কর্মসূচীর অভাবে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টরা প্রাধান্যলাভ করতে সক্ষম হয়নি। সঙ্গতিপূর্ণ বুর্জোয়া কর্মসূচীর রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে পূর্ববাঙলার বাঙালী বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করতে সক্ষম হয়।

রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রান্ত তত্ত্বগত লাইনটি হলো ভারত ও পাকিস্তান রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র নয়। ভারত ও পাকিস্তানে অংশতঃ পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছে, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে ওঠেনি। এই দুটি দেশে পুঁজিবাদ মূলতঃ স্বাধীন নয়। ভারত ও পাকিস্তানের পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ কতৃক মূলতঃ নিয়ন্ত্রিত। ভারত ও পাকিস্তানের মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম গণতান্ত্রিক (বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক)।

তত্ত্বগত বিচারে পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৭১) রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র। পাকিস্তানের উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিবাদী। পূর্ববাঙলায়, পাকিস্তানে শ্রমিকশ্রেণীর মেহনতী জনগণের প্রধান সংগ্রাম সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম। রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রান্ত তত্ত্বগত লাইনের কারণে পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টরা পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা দেশে প্রধানতঃ সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (বিশেষতঃ পূর্ববাঙলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শ্রেণীচরিত্র ছিল বস্তুতঃ সমাজতান্ত্রিক (সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক)। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রধানত পুঁজিবাদী শোষণ বিরোধী এবং পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদী শোষণ বিরোধী। পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টদের, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পশ্চাদপদ তত্ত্বগত অবস্থানের কারণে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শ্রেণীচরিত্র প্রধানতঃ আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক (বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক) রূপ নেয়।

তত্ত্বগত বিভ্রান্তির কারণে পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টরা পাকিস্তান আমলে ও বাঙলাদেশ আমলে প্রধানতঃ সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি। ফলে পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টরা ঐক্যবদ্ধভাবে ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। পঁচিশ মার্চের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্ববাঙলার জনগণের প্রধান সংগ্রাম একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে (গণতান্ত্রিক সংগ্রাম) পূর্ববাঙলার কমিউনিস্টরা গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে আসাদের মৃত্যুর তাৎপর্য যথাযথ উপলব্ধ হয়নি। বাঙলাদেশ আমলেও আসাদের মৃত্যুর তাৎপর্য যথাযথ নির্ণয় হয়নি।

যেহেতু, বাঙলাদেশ (১৯৭১-২০১১) রাজনৈতিভাবে স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র। বাঙলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিবাদী এবং সমাজ পুঁজিবাদী সমাজ। সেহেতু সঠিক কর্মসূচীর ভিত্তিতে বাঙলাদেশে চলমান সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম ক্রমশঃ শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বিশেষভাবে সংগঠিত হবে। বাঙলাদেশে প্রধানতঃ সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের গুণগত বিকাশের মধ্য দিয়ে হিমালয় পাহাড়ের মত ভারী আসাদের মৃত্যুর তাৎপর্য যথাযথ নির্ণয় হবে।

তারিখঃ ২৪.০১.২০১১
আইউব রেজা চৌধুরী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন